কালো রঙ মানেই বেরোবি,র/রংপুরের রনি
প্রিয় রঙ কালো। হ্যা,কালো। কালো আধারের রঙ। আধারকে আমি ভিষণ পছন্দ করি। কালো আছে বলেই আলোর অস্তিত্ব এত সুন্দর।কালো না থাকলে আলোর উপস্থিতি অর্থহীন, আলোর উপস্থিতি বুঝতে হলে প্রথমে কালোকে বুঝতে হবে। এই কথাগুলোই বলছিলেন মো: মোর্শেদ উল আলম রনি।
তার নাম শুনতেই চোখে ভেসে আসে কালো পোষাক পরিহিত সেই ব্যক্তিটি। রনি বর্তমানে কর্মরত আছেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিপুটি রেজিস্ট্রার হিসেবে। তিনি দীর্ঘ ১৫ বছরেরও বেশী সময় ধরে শুধুমাত্র কালো রঙের পোষাক পরিধান করে আসছেন। এমনকি তার পায়ে সু থেকে শুরু করে মাথার টুপি, বাইক, চশমা, হাত ঘড়ি, মোবাইলের রঙও কালো। এভাবেই কালো পোশাকের ফ্যাশনে চলে তার আধুনিক আভিজাত্যের ছোঁয়া।
যেমন হিমুর রঙ হুলুদ,রুপার রঙ নীল তেমনি রনির রঙ কালো। নিজস্ব চিন্তা ভাবনা থেকেই কালোর প্রতি দূর্বলতা জন্ম নেয় প্রায় ১৫ বছর আগে। তখন তিনি অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। প্রত্যেক মানুষের কাছেই তার নিজস্ব একটা পছন্দের রঙ থাকে, তেমনই তার পছন্দের রঙ কালো । কালো সাধনার রঙ,আর এই সাধনা করতে করতে তিনি এই কালোকে তার আশপাশের সকল মানুষের কাছে একটি ব্রান্ডে পরিনত করেছেন। তাকে যারা চেনে এমন মানুষের কাছে কালো মানেই রনির প্রতিচ্ছবি।
পৃথিবীতে এতো এতো রঙ থাকতেও রনি শুধুমাত্র কালো পরিধান করেন। সকল ঋতুতেই তিনি সমানভাবে এই কালো পোষাক পরিধান করেন। গড়মের দিনেও এই কালো পোষাক পড়তে কোন রকম অসুবিধা হয় না। প্রথম প্রথম অনেক অসুবিধা হোত। প্রচন্ড গড়মে অনেক কষ্ট হতো । পরে আস্তে আস্তে অভ্যেসে গড়ে তুলেছেন । এখন প্রচন্ড গড়মেও অস্বাভাবিক কিছু মনে করেন না তিনি।
তিনি জানান, প্রথমে অবশ্য এই কালোর কালেকশন করতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। দোকানের পর দোকান খুঁজে খুঁজে কালো কালারের ড্রেস সংগ্রহ করতে হতো। পরে দোকানীরা বিষয়টা যখন জেনেছেন তখন তাদের কাছে বিশেষ কোন কালো পোষাক আসলে তারাই আমাকে ফোন করে করে জানাত। মজার বিষয় হলো এখন কোথাও যদি আমার পরিচিত কেউ কালো রং এর ড্রেস দেখে তখনেই আমার কথা মনে করে এবং তারা এসে সেটা আমাকে জানায়। সময় সুযোগ করে ছুটে চলি কালোর সন্ধানে কালো বাইকটা সাথে নিয়ে।
রনি বাহুল্য বর্জনকরে মহাত্মা গান্ধী, আবুল মকসুদের মতো এক রঙয়ের পোশাক পরিধান করেন। যদিও পেশাগত জীবনেও প্রথমে কালোর কারণে শুনেছেন অনেক কটুকথা। তারপরে এই কালোর কারণে পেয়েছেন অন্যন্য সম্মান, স্নেহ ভালবাসা। কালোর কারণে কুৎসিত ভাষায় তারদিকে মন্তব্য ছুড়ে দিতেন অনেকই। কেউবা বলতেন প্রেম করে ব্যর্থ হয়েছেন তাই হয়তো এমনটা করেন। সবসময় এই কালো ড্রেস পরার কারনে অনেক জায়গায় অনেক মজার ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। অচেনা কোন জায়গায় গেলেই তাকে র্যাবে চাকুরী করেন বলে মনে করেন অনেকেই। কিছু কিছু জায়গায় তিনি যে র্যাবে চাকুরী করেন না বা কোন ডিফেন্সেই চাকুরি করেন না এটা বুঝাতেই পারেন না। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পরিচিত ব্লাক রনি নামে। যেন কালো মানেই রনি।
তবে জীবনে দুইটা বিষয় নিয়ে খুব টেনশন ছিলেন, এক বিয়ের দিনের পোষাক নিয়ে আর কোন পেশায় যাবেন সেই পেশায় কোন ড্রেস কোড থাকবে কিনা সেটা নিয়ে। কিন্তু দুই পর্যায়েই তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন বেশ সফলতার সাথে। বিয়ের দিনেও তিনি কালো কালারের ড্রেস পরেই বিয়ে করেছেন। আর যেহেতু তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরীতে যোগদান করেছেন তাই এখানেও ড্রেস কোড নিয়ে কোন বার নেই। এভাবে দেখতে দেখতেই পার হয়ে গিয়েছে ১৫ টি বছর। এবার তার চিন্তা খুব দ্রুতই গিনেস বুকে আবেদন করার।
তিনি বলেছেন, যে আমি এখনও জানিনা গিনেজ বুকে এ রকম বিষয়ে কোন রেকর্ড কারো এ পর্যন্ত আছে কিনা। তবে আমারচাওয়া, যেহেতু এত বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে আমি কালো পোষাক পরিধান করে আসছি তাই গিনেজবুকে আমার বিষয়টা স্থান পেলে স্বার্থকতা পেত।
কালো পোষাক নিয়েতার পরিবারে মন্তব্য কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথমে আমার মা একটু বলতেন এত কালো কাপড় পরি কেন? এত কালো কাপড় পরতে নিষেধ করতেন। অনেক সময় লুকায়ও রাখতেন। পরবর্তীতে আরকিছু বলেননি। তবে আমার নানু আমাকে যেমন ভালবাসতেন তেমনি মাঝে মাঝে রাগও করতেন কালো পোষাকের জন্য। পরে অবশ্য বলেছিলেন তার পরিচিত কিছু বিখ্যাত ব্যক্তিদের কথা যারা এমন এক কালারের কাপর পরিধান করতেন।
রনির স্ত্রী বলেন,এমনিতেই তাকে কালো কালারের ড্রেসে ভালো লাগে কিন্তু সবসময় এই একই কালারের কাপড় পরার জন্য মাঝে মাঝে বিরক্তও লাগে। সবচেয়ে বেশী সমস্যা হয় যখন কোন একটা নির্দিষ্ট ড্রেসপরার জন্য চিন্তা করার পর সমস্ত আলমিরা আর ওয়ারড্রব তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়। তখন মেজাজটা খারাপ হয়ে যায়। কারন তার সব কাপড়ই কালো। খোজার সময় সব কাপড়কেই একই রকম লাগে।
রনির স্ত্রী আরোও বলেন, বিয়ের পর তাকে প্রথম যে শাড়িটা এবং প্রথম যে জামাটা রনি নিজেই পছন্দ করে কিনেদিয়েছে সেটাও ছিল কালো। তার স্ত্রীর পাছন্দের রং লাল। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও আমি তাকে লাল বা অন্য কালারের জামা-কাপর পরাতে পারিনি। এখন ভাবি ও যেটা পছন্দ করে সেটাই পড়ুক এবং আমি এখন ওর জন্য সবথেকে সুন্দর কালো পোষাকটাই পছন্দ করে দিতে সাহায্য করি হোক সেটা কালো শার্ট, গেঞ্জি,ফতুয়া বা পাঞ্জাবী। তবে কোন একদিন তিনি কালো ছাড়বেন এইআশা করি।
আরো কথা হয় রনির পরিচিত কয়েক জনের সাথে যারা তাকে দীর্ঘদিন ধরে চেনেন। তিনি যেখান থেকে সবসময় কাপড় লন্ড্রি করেন সেই রংপুর লন্ডীর মালিক অনোয়ার হোসেন বলেন, এই স্যার আমার দোকানে অনেকদিন থেকে আসেন শুধু কালো পোষাক লন্ড্রি করতে। স্যার যে কেন শুধু কালো পড়েন এটা আমার জানা নেই। তবে আমার দোকানের সকল স্ট্যাফরা খুব কৌতুহল এটা জানার জন্য। স্যারের কাপড় আমাদের খুঁজতে বেশি সময় লাগে না। কালো মানেই আমরা মনে করি রনি স্যারের কাপড়।
রংপুর সিটি বাজারের নিউ মনিষা চাউল ভান্ডারের মকসু বলেন, আমার ব্যাবসা জীবনের ১৪/১৫ বছরে আমি তাকে কালো ছাড়া কোন পোষাকে দেখিনি। তার সব কিছুই কালো রঙয়ের। এমনকি তার বাইকটাও কালো।স্যার কালোর ঙটা খুব ভালোবাসেন। যখন তিনি আমার দোকানে আসেন আশেপাশের দোকানদাররা তার দিকে তাকিয়ে থাকেন।
রংপুর সুপার মার্কেটেররংধনু ফ্যশানের মালিক বাবু বলেন, তিনি আমার দোকান থেকে ১২/১৩ বছর যাবত কালো পোষাক কেনেন।দোকানে কোন নতুন কালো পোষাক আনলেই তাকে ফোন করি। রনি ভাই অনেক ভালো মনের মানুষ। তিনিঠিক কি কারনে কালো পরিধান করেন আমরা সেটা আজও জানিনা। তাকে অনেকবার এর কারন জানতে চেয়েছিকিন্তু এর রহস্য আজও আমাদের জানায়নি। তবে আমার কাছে তার এই কালো ড্রেসের বিষয়টা খুবভালো লাগে। এ কারনে তাকে অন্যদের থেকে ব্যতিক্রমী মনে হয়।
রনির দীর্ঘদিনের সহকর্মী ফিরোজুল ইসলাম বলেন, আমরা ১২ বছরের বেশী সময় ধরে একসাথে চাকুরী করছি। রনি ভাইয়ের পোষাকের নিজস্বতার বিষয়টা আমার কাছে খুব ভালো লাগে। আমি মনে করি দীর্ঘদিন ধরে কালোরং এর পোষাক পরিধান করে তিনি একটা আলাদা বিশেষত্ব তৈরী করেছেন যেটার মাধ্যমে তার একটি আলাদা ব্যক্তিত্বও প্রকাশ পায়। কালো পোষাকে তাকে অনেক ভালো লাগে। তার এই দীর্ঘ সাধনার সাধুবাদ জানাই।
রনি শুধু কালো পোষাক পরিধানেই সীমাবদ্ধ না, তার সংগ্রহে আছে বাহারি রকমের দেশী-বিদেশী কালো কালারের পানির মগ। তিনি বই পড়তে অনেক ভালোবাসেন। তার বাড়িতে ছোট একটি লাইব্রেরীও আছে। সেখানে রয়েছে নানা রকমের বই এর সমাহার।তার পরিচিত সকলের মনেই একটি কমন প্রশ্ন জাগে কেন তিনি নিয়মিত এই কালো কালারের পোশাক পরেন। এই প্রশ্নেরজবাব তিনি হাস্যউজ্জলভঙ্গিতে বিনয়ের সাথে সবসময়েই এড়িয়ে গেছেন এবং তিনি সবাইকে হূমায়ুন আহমেদের মিসির আলির মত ঠিক একই ভাবে উত্তর দিয়ে বলে থাকেন থাক না কিছু প্রশ্নের উত্তর অজানা.. থাক না কিছু রহস্য অমিমাংসীত…###
লেখক, কেএম হিমেল আহমেদ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়,রংপুর
বিশেষ প্রতিনিধিঃ সিএনবি